বাতায়ন

আশেপাশে চারপাশে সংকটের মাঝে ডেঙ্গু আতঙ্কে দিশেহারা মানুষ

  প্রতিনিধি ৯ জুলাই ২০২৩ , ১:৪৩:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে জাতি যখন বিপর্যস্ত, ঠিক সে সময়ে ডেঙ্গু আতঙ্ক গ্রাস করেছে বাংলাদেশকে। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। হবে না কেন, কাগজে যতটুকু খবর আসছে, পরিস্থিতি আসলে তার চেয়েও ভয়াবহ।

ঢাকার হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করার জায়গা নেই। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু ভয়ানক রূপ নিতে পারে।

চার বছর আগে ২০১৯ সালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় গিয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক-বর্ষা জরিপের তথ্য বলছে, এবারের পরিস্থিতি ২০১৯ সালের চেয়েও কয়েকগুণ খারাপ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৫টিই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৯ সালে উচ্চঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ড ছিল ২১টি।

পরিস্থিতি ভয়াবহ

২০১৯ সালে বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৮। চলতি ২০২৩ সালে একই সময়ে মারা গেছেন ৬১ জন। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল ২২০৮ জন। চলতি বছর একই সময়ে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৯,৮৭১। এ তথ্য থেকেই বোঝা যায় এ বছর পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে। আরও যদি খারাপ হয় তখন অবস্থাটা কী দাঁড়াবে?

এখনই হাসপাতালে জায়গা নেই, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে রোগীরা কোথায় যাবে? প্রাথমিক অবস্থায় রোগীকে বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া যায়; কিন্তু এক সময় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, রক্ত দিতে হয়, স্যালাইন দিতে হয়। ভবিষ্যতে সরকার ও কর্তৃপক্ষ কীভাবে পরিস্থিতির সামাল দেবে, বুঝতে পারছি না। মৃতের সংখ্যা তখন বাড়তেই থাকবে। এটি কারোই কাম্য হতে পারে না।

ডেঙ্গুর কোনো প্রতিষেধক বা টিকা নেই। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা। এডিস মশা কামড় দিলেই ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মশাকে তো বলা যাবে না, আমাকে কামড় দিও না। কাজেই মশা ও মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। বাসাবাড়ির বিভিন্ন স্থানে, ড্রেন, নিচু জায়গায় পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা ডিম পাড়ে, মশার জন্ম হয়। নগরবাসীকে পৌরপিতারা এবং পৌর কর্মকর্তারা অবিরত উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু তারা নিজেরা কী করছেন? নিজ দায়িত্ব তারা পালন করছেন কি? এ বিষয়ে সবার প্রশ্ন রয়েছে।

কাউন্সিলররা কী করছেন?

পৌর করপোরেশন বা পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলররা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। তাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা ও অফিস-কর্মচারী দেওয়া হয় জনহিতকর কাজের জন্য। একজন কাউন্সিলরের আওতাধীন এলাকা বিরাট কিছু নয়। তিনি তার এলাকার বাসাবাড়িতে গিয়ে যদি খোঁজ করেন সেখানে মশার প্রজননস্থল আছে কিনা, তাকে কে বাধা দেবে? কিন্তু তারা কি তা করেন? করেন না। কেউ কেউ কালেভদ্রে লোকদেখানো কিছু করেন। মাননীয় মেয়র মহোদয়রা, কাউন্সিলররা কী করছেন খবর রাখেন কি?

মশা নিয়ন্ত্রণে কাউন্সিলরদের একমাত্র দৃশ্যমান কাজ হচ্ছে ‘ফগার মেশিন’ দিয়ে ধোঁয়া ছড়ানো। এতে মশা তো মরেই না, বরং মানুষের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। অনুমান করা যায়, ফগার মেশিন ও তার ওষুধ আমদানির মাধ্যমে ভালোই বাণিজ্য হচ্ছে কিছু লোকের। ডোবা, নর্দমা, নিচু জায়গায় জমে থাকা পানি ও আবর্জনায় মশার ওষুধ ছিটানো হয় না কেন? মূল্যবান ফগার মেশিন আমদানির আগে শুধু ওষুধ ছিটিয়ে মশার বংশবিস্তার রোধ করা হতো।

তখন হয়েছিল, এখন কেন হয় না?

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। তার আমলে ঢাকা শহর সম্পূর্ণ মশামুক্ত ছিল। তার হাতে কি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা ছিল? তা নয়। তিনি শুধু মশার ওষুধ ছিটিয়ে এবং নালা-নর্দমা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে ঢাকা শহর থেকে মশা তাড়িয়েছিলেন। সে আমলে ফগার মেশিন বা আধুনিক সরঞ্জাম ছিল না। তার ছিল সদিচ্ছা, সে সদিচ্ছার বলেই তিনি ঢাকা শহরকে মশামুক্ত করেছিলেন। ঢাকার প্রবীণ নাগরিকরা এখনো সে কথা স্মরণ করেন।

হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী পেরেছিলেন, কিন্তু এখনকার স্মার্ট কর্তাব্যক্তিরা পারেন না কেন? কারণটা সহজেই অনুমেয়-সদিচ্ছার ঘাটতি। পৌর কাউন্সিলররা তো রাজনীতি, নির্বাচন ও বিভিন্ন অনুন্নয়নশীল কাজেই বেশি সময় ব্যস্ত থাকেন। মশার মতো তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ভাবার সময় তাদের আছে কি?

মশা মারতে কামান দাগা

খবরে জানা গেল, মশার উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করতে ঢাকা শহরে অত্যাধুনিক ড্রোন ব্যবহার করা হবে। ব্যাপারটা মশা মারতে কামান দাগার মতো হচ্ছে না কি? মানুষ দিয়ে যে কাজ করা সম্ভব, সেখানে শহরের আকাশে ড্রোন উড়াতে হবে কেন? পৌর কর্মকর্তা-কাউন্সিলররা ভালো করেই জানেন মশা কোথায় জন্মায়। ড্রোন উড়িয়ে মশার ক্ষতি না হলেও কিছু লোকের লাভ হবে সন্দেহ নেই।

এ লেখার শুরুতেই বলেছিলাম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের কথা। এ সংকটের কারণে বিপর্যস্ত জনগণ মোটেই শান্তিতে বা স্বস্তিতে নেই। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, বাদানুবাদ এখন কাদা ছোড়াছুড়ির পর্যায়ে চলে গেছে। পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে সংঘাত-সহিংসতা। রাজনৈতিক অস্থিরতা পানি আরও ঘোলা করবে। ঘোলা পানিতে ফায়দা লুটবে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা তথা অসাধু সিন্ডিকেট।

লুটেরা সিন্ডিকেটের বদৌলতে ইতোমধ্যেই জনগণ তথা ভোক্তাদের দুরবস্থা চরমে। এমন একটিও নিত্যপণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি এবং ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়নি। কাঁচামরিচ ৮০০ টাকা কেজিতে কিনতে হবে, তা কি কেউ কখনো কল্পনা করতে পেরেছিলেন? কাঁচামরিচের মতো পণ্যের আকাশচুম্বী মূল্যের কারণ সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা এবং সিন্ডিকেট নামক দুষ্টচক্রের কারসাজি।

সিন্ডিকেট এবং অসহায় মানুষ

সরকার ভালো করেই জানে সিন্ডিকেট কে বা কারা। তাহলে তাদের দমন করা হয় না কেন? কারণ, সিন্ডিকেটকে সরকার বোধহয় ভয় করে। নির্বাচনের আগে চটাতে চায় না মনে হয়। আর এ সুযোগে সিন্ডিকেট নামক ‘মহাশক্তিধর’ অদৃশ্য শক্তি জনগণের গলা কাটছে।

একদিকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট, পাশাপাশি ডেঙ্গুর আতঙ্ক, যা এখন করোনার মতো মহামারির রূপ নিতে চলেছে। সংকটে, আতঙ্কে দিশেহারা জনগণ। এদেশের মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত-নিুবিত্ত-দরিদ্ররা এতিম শিশুর মতো অসহায় হয়ে পড়েছে।

চপল বাশার : সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com