বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কারের নানা দিক : নির্বাচনি রোডম্যাপ

  প্রতিনিধি ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৯:২৭:১৪ প্রিন্ট সংস্করণ

১. রাজনৈতিক সংগঠনগুলো দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে আন্দোলন, সংগ্রাম, লড়াই, রক্তপাত ঝরিয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারকে হটাতে পারেনি। কারণ জনগণ রাজনৈতিক জোটের শাসনামল প্রত্যক্ষ করেছে। জনগণের মালিকানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার পরিবর্তে দুঃশাসন ও দুর্নীতির রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে কারণে জনগণ কোনো রাজনৈতিক দলের ওপরে আস্থা রাখতে পারেনি। দলগুলো যখন বিপন্ন, ছন্নছাড়া ও হতাশায় নিমজ্জিত তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের কোটাবিরোধী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রক্ত¯œাত হয়ে এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ঘটে। তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান।

২. ইদানীং ছাত্র-জনতার অভাবনীয় বিজয়কে ঘিরে বহু অংশীজনকে দেখা যাচ্ছে। তারা বিস্মৃত হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুধু সরকার পতন নয়, রাষ্ট্র সংস্কার করার অঙ্গীকার করেছে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত এবং মৃত্যুর গুহা পেরিয়ে জাতির ক্রান্তিলগ্নে সঠিকভাবে নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছেন। এ সন্ধিক্ষণে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর ত্বরিত ভূমিকা ব্যাপক রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করেছে যা মুছে ফেলা যাবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য আমাদের বলে দেয় জাতির আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের কথা। সে স্বপ্ন হলো রাষ্ট্র সংস্কার। যেখানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকার স্থায়ীভাবে অনির্বাণ থাকবে। সংস্কারের মধ্যে ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করছেন। সংলাপে কয়েকটি বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।

যেমন- ক. একনাগাড়ে কেউই দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকবেন না। এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। পুনরায় স্বৈরাচার উত্থান না হতে পারে তার রক্ষাকবজ হবে, যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি দলীয় প্রধান হবেন না। দলীয় গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্রায়ণ জরুরি, একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন আবশ্যক। 

খ. কেউ কেউ এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, সংবিধান পুনর্লিখন কিংবা ১৯৭২ সালের রচিত সংবিধান বাতিল করতে হবে। এই অভিমত আবেগজড়িত। সংস্কার প্রস্তাবের মর্মবস্তু সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত করা যেতে পারে কিন্তু কোনো ক্রমেই সংবিধান বাতিল করে নয়, যা হবে আত্মঘাতী পদক্ষেপ। এই সংবিধানের মাধ্যমেই অন্তর্বর্তী সরকার শপথ ‘সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানের অঙ্গীকার’ করেছেন। কিন্তু ১১২ অনুচ্ছেদ সংবিধান সংশোধনের দরজা উন্মুক্ত রয়েছে।

গ. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। সংবিধানের ৪৮ক অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। এর অর্থ হলো- একটি দলের মনোনীত রাষ্ট্রপতি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান। তার আসন অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে। এর অর্থ তিনি কোনো দলের নয়। সর্বস্তরের, সব মানুষের। সে জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত হলে রাষ্ট্রপতি পদটি সর্বজনীন হয়ে উঠবে। ৪৮ (৫) অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিধি বিন্যস্ত করা যেতে পারে।

ঘ. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়ার কথা হচ্ছে। ‘হর্স ট্রেডিংয়ের’ সম্ভাবনা উন্মুক্ত থাকে। বরং এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে, যে দলের যে কোনো সদস্যই সংসদে মুক্ত আলোচনা করবেন, প্রয়োজনে যে দল থেকে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন সে দলের কর্মকান্ড সম্পর্কে জনস্বার্থে তার সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বর উচ্চকিত থাকবে। এ ক্ষেত্রে তিনি থাকবেন স্বাধীন। পার্লামেন্টারি পার্টি বা দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে না বা তার আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারবে না। তবে অর্থবিলে দলের পক্ষে থাকবেন। সংবিধান কমিশন গঠন করে সংবিধান সংশোধনপূর্বক সংস্কার প্রক্রিয়া যেন ত্বরান্বিত হয়।

৩. অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস অতিবাহিত হয়েছে। প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রয়োজন অবিলম্বে পুলিশ ও প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন ও বাস্তবায়ন জরুরি। একটি খুনের মামলায় হুকুমের আসামি ১০ জন এবং অজ্ঞাতনামা ১ হাজার/২ হাজার। কর্তৃত্ববাদী শাসনে যেমনটি হয়েছে সেই রীতি ও নীতি এখনো চলছে। এর ফলে প্রকৃত আসামি আইনি কৌশলে খালাস পেয়ে যাবে।

৪. সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক দলকে বিদায় করে দিয়ে রাতারাতি অন্য দলকে বসানো হচ্ছে। মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার নিরিখে এসব করা হচ্ছে কি না পর্যালোচনা করা উচিত। তাদের আমলনামার ভিত্তিত্তে, না আগের মতো দলীয়করণকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বাবুল মিয়া সাত দিনের মধ্যে তিনবার প্রমোশন পেয়েছেন। কোনো তুঘলকি কর্মকান্ড হওয়া উচিত নয়।

৫. আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। সেই কমিটি পতিত স্বৈরাচার আমলের শ্বেতপ্রত্র প্রণয়ন করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- বিশাল আর্থিক খাত নিয়ে সমন্বিত কার্যকর কমিশন গঠন প্রয়োজন। যারা ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার  এবং ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শাস্তির দাবি জনগণের। কালো টাকা সাদা করার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হলেও সেই কালো টাকার মালিকদের নাম প্রকাশ করা উচিত। কালো টাকা অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করা উচিত। মেগা প্রকল্প অর্থই মেগা দুর্নীতি। দুর্নীতি রাষ্ট্র, সমাজ, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে বিস্তৃত। দুর্নীতি দমন কমিশন কুলিয়ে উঠতে পারছে না। পরাক্রমশালী দুর্নীতিবাজদের বিচারের জন্য ন্যায়পাল কমিশন জরুরিভাবে গঠন করা বাঞ্ছনীয়।

৬. স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি না থাকায় সরকার ও জনগণ নানাভাবে হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সংস্কার করে তার ক্ষমতা ও পরিধি বিস্তৃতিকরণ এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার গ্যারান্টি দেওয়া প্রয়োজন। ফলে সরকারের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে। সরকার প্রণোদনা দেবে।

৭. নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আইনের ঘাটতি নেই। ঘাটতি রয়েছে প্রয়োগে। সংবিধানে ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে ‘তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণের’ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভারতের সংবিধানে ‘নিয়ন্ত্রণের’ কথাটি উল্লেখ থাকায় তারা নির্বাচনে নির্বাহী কর্র্তৃপক্ষকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশে গত কয়েকটি নির্বাচনে লক্ষ করা গেছে, নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনি কাঠামোয় সশস্ত্র বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট করা উত্তম। জাতিসংঘের পিস কিপিংয়ের মাধ্যমে তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো প্রয়োজন।

৮. বিচার বিভাগ স্বাধীন নয়। ১১৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে, কোন ভিত্তিতে হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের রাতারাতি নিয়োগ দিয়েছে। একই সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে রাতারাতি নতুন করে শতাধিক ডেপুটি, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ। সব নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা উচিত।

৯. রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক এসব বিষয়াদি পরিষ্কার করে, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি করার পরেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন। অনেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার এগিয়ে নিতে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলছেন। ‘যৌক্তিক সময়’ একটি তেলে-ভাসা কথা। কারণ জাতি হিসেবে আমরা অসহিষ্ণু। ধৈর্য কম। আমরা অর্জিত বিজয়কে ধরে রাখতে পারি না। ডাক্তার যেমন রোগ নির্ণয় করতে রোগীর পালসে হাত রাখেন, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকার পাবলিক পারসেপশন অনুযায়ী এক-দেড় বছরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারলে তাদের সফলতার ইতিহাস মাইলফলক হয়ে থাকবে।

১০. ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে একটি গণতান্ত্রিক, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারায় জাতির লালিত স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত হবে সেটাই কাম্য। একই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহৎ আদর্শ ও দর্শন যেন আরও বিকশিত হয় সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বাঙালি জাতির সংগ্রামের ঐতিহাসিক অধ্যায় ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মসূত্র যেন বিস্মৃত না হই এবং জাতিরাষ্ট্রের পিতাকে দলমতের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।  এ কথাও মনে রাখতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক।  এ ক্ষেত্রে যে বা যারা মুক্তিযুদ্ধ ও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি দৃঢ়নিষ্ঠ তাদের মধ্যে যারা নতুন কাঠামো ও নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় পুনর্গঠিত করতে চান, আমি তাদের একান্ত সহযোগী।

 

লেখক : ’৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও গবেষক

আরও খবর

Sponsered content