আন্তজার্তিক

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগীরা যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি কেনার জন্য ৪০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছেন

  প্রতিনিধি ১ ডিসেম্বর ২০২৪ , ১১:৪৮:০৬ প্রিন্ট সংস্করণ

আ জা আন্ত ডেস্ক:
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগীরা যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি কেনার জন্য ৪০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছেন বলে এক তদন্তে জানা গেছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য অবজারভারের এক যৌথ তদন্তে  এ তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতির জন্য দায়ী বাংলাদেশি প্রভাবশালীরা প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে যুক্তরাজ্যে রিয়েল এস্টেট কিনেছেন। এর বাইরে তাদের আরও সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

শনিবার (৩০ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা দ্য গার্ডিয়ান।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ততক্ষণে গণভবনে ঢুকে পড়ে লাখো জনতা। হাজারো মরদেহ আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আহতদের ওপর ভর করে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থান ঘটে।

তখন থেকেই ভারতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। এদিকে হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলের পর দেশ পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ক্ষেত্রে হাসিনার দলের লোকজন বিদেশে যে অর্থপাচার করেছে, সেসব অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত প্রয়োজন বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

গার্ডিয়ান জানায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি প্রভাবশালী পরিবার অবৈধভাবে কয়েক বিলিয়ন পাউন্ড অর্জন করেছে। যার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে নেওয়া অপরিশোধিত বিশাল ঋণও রয়েছে।

আর্থিক অপরাধ তদন্তের সঙ্গে জড়িতদের ধারণা, দক্ষিণ এশিয়ায় বহুল প্রচলিত অর্থ স্থানান্তরের হুন্ডি পদ্ধতি ব্যবহার করে এসব অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে।

তদন্তকারীদের মতে, ওই অর্থের কিছু অংশ সম্পদ কেনার পরিচিত গন্তব্য যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বৈশ্বিক পেপার ট্রেল অনুসরণ করে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ইউরোর অনুসন্ধানের পর জানতে পারে, ওই অর্থ দিয়ে লন্ডনে গোপনে সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে।

শনিবার (৩০ নভেম্বর) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে দ্য অবজারভারের যৌথ তদন্তে বলা হয়, ‘যুক্তরাজ্যে সাধারণ ফ্ল্যাট থেকে অট্টালিকা মতো ৩৫০টি সম্পত্তির নেটওয়ার্ক রয়েছে। বাংলাদেশি ধনী ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন অফশোর কোম্পানির পাশাপাশি শেখ হাসিনা সরকারের দুই সাবেক মন্ত্রীর তথ্য পাওয়া গেছে।’

তবে সরকারিভাবে এ ধরনের অনুসন্ধান ব্রিটিশ ফার্মগুলোর পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়। এদের মধ্যে ব্যাংক, আইনি ফার্ম ও এজেন্টরাও রয়েছেন। তারা মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে সম্পত্তি বেচাকেনায় বেশ ভালো সম্মানী পেয়ে থাকেন।

অবৈধ অর্থ দিয়ে ব্রিটেনে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তোলার তথ্য পাওয়া গেছে তাতে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে যে, ব্রিটেনে সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে নেপথ্য পরিচয় ও গ্রাহকের অর্থের উৎস যাচাই করার নিয়ম যথার্থ কিনা?

ফলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, লন্ডনকে বিশ্বের দুর্নীতিবিরোধী রাজধানী করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে এই ঘটনার দ্বারা তারা প্রথম পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে।

মন্ত্রীর ভূমি ও ভূমিমন্ত্রী

শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পর সালমান এফ রহমান ঢাকার নৌকায় করে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেপ্তার হন। তিনি শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। অনেকেই তাকে আওয়ামী লীগের শাসনামলের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখেন।

তিনি এখন ঢাকায় অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও একটি বিশেষজ্ঞ তদন্তকারী ইউনিটের মাধ্যমে অর্থপাচারের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তার এবং পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে।

সালমান এফ রহমান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম কোম্পানি বেক্সিমকোর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাইস চেয়ারম্যান। পোশাক তৈরি থেকে শুরু করে ফার্মাসিউটিক্যালস পর্যন্ত তাদের ব্যবসা বিস্তৃত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেক্সিমকো যেসব সুবিধা ভোগ করেছে বলে জানা গেছে, তার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের সুযোগটি রয়েছে।

তবে এখন বেক্সিমকোর প্রায় ১ বিলিয়ন ইউরোর অপরিশোধিত ঋণের বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তদন্তাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংক তার অর্থ তদারকির জন্য একজন কাস্টডিয়ান নিয়োগ করেছে।

বেক্সিমকো পারিবারিক ব্যবসার উত্তরসূরি বহন করছে। লিংকডইন ও কোম্পানিটির ঘোষণা অনুযায়ী, সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান ও তার ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার উভয়েই গ্রুপটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে বহাল। তারা মূল কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। বর্তমানে দুজনেই বিষয়ে সিআইডি তদন্ত করছে। দেশে শায়ানের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।

পাচারকৃত অর্থের সন্ধানকারী কর্তৃপক্ষ লন্ডনের মেফেয়ারের গ্রোসভেনর স্কয়ারের খোঁজ পেয়েছেন। যা যুক্তরাজ্যের রাজধানীর ১৮ শতকের বাগান ঘেরা বসতস্থানের মধ্যে বৃহত্তম ও সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ।

সালমান এফ রহমানের পরিবারের সেখানে সাতটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা বা অংশীদারত্ব রয়েছে। বেশিরভাগই অফমোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা। এর মধ্যে ২০২২ সালের মার্চে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কোম্পানির মাধ্যমে শায়ান রহমান ২৬ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ইউরোর সম্পত্তি কেনেন। তিনি সাড়ে ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর আরেকটি ফ্ল্যাটের মালিক।

তার চাচাতো ভাই আহমেদ শাহরিয়ার অধীনস্থ বেনামি কোম্পানিগুলো একই স্থানে ও কাছাকাছি। তিনি ২৩ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের আরো চারটি সম্পত্তির মালিক।

শায়ান রহমান ও আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের আইনজীবীরা বলেছেন, সম্পত্তিগুলো মানি লন্ডারিংয়ের নিয়মসহ আর্থিক বিধিমালা সম্পূর্ণ মেনে কেনা হয়েছে।

তারা বলেছেন, ঢাকায় বেক্সিমকোর তদন্ত সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের তদন্ত রপ্তানি বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর এই কথার বিরোধিতা করেছেন। তিনি অবজারভারকে বলেন, ‘যারা বাংলাদেশ থেকে সম্পদ নিয়েছে এটি তাদের বিরুদ্ধে একটি বৈধ আইনি প্রক্রিয়া। আমরা এগুলো ফেরত পেতে চাই।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে যে দেশের হারানো সম্পদের তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের শত্রু নন। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি ও সুশীল সমাজের ভূমিকা রয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো বিএফআইইউ জব্দ করেছে। ঢাকার একটি আদালত তার এবং পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন স্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন তার অবৈধভাবে কয়েক মিলিয়ন ডলারের বিষয়ে অভিযোগ তদন্ত করছে।

তদন্তকারীরা জানতে চান কীভাবে তিনি এবং তার পরিবার যুক্তরাজ্যে ৩০০টিরও বেশি বাড়ি কিনেছেন। যা যুক্তরাজ্যের ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অনুসারে কমপক্ষে ১৬০ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে কেনা হয়েছে।তবে, বাস্তবে ব্রিটেনে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সম্পত্তি আরও বেশি হতে পারে বলে অবজারভারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এ বিপুল পরিামণ অর্থ সম্পদ পাচার ঠেকাতে ব্রিটেনের অপারগতা সম্পর্কে দুর্নীতি বিরোধী অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের (এপিপিজি) চেয়ারপারসন জো পাওয়েল বলেন, ‘আমাদের আরও শক্তিশালী অ্যান্টি-মনি-লন্ডারিং তত্ত্বাবধান এবং প্রয়োগ প্রয়োজন। যেন লন্ডনে প্রবাহিত সম্পদের উৎস বিশ্লেষণ করা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সকল প্রচেষ্টাকে সমর্থন করি। তারা তাদের দেশের অসদুপায়ে অর্জিত ও পাচার করা অর্থ-সম্পদের অনুসন্ধান করতে চান।এদিকে যুক্তরাজ্যের আর্থিক খাতের বিষয়গুলো পর্যালোচনা ও হালনাগাদের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হলেন সিটিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে।

২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল যে টিউলিপ সিদ্দিকের মা শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা লন্ডনের একটি বিলাসবহুল বাড়িতে বিনামূল্যে বসবাস করছিলেন যা আহমেদ শায়ান রহমানের মালিকানাধীন।

অবৈধ অর্থপাচার সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সতর্ক করে বলেছে যে, যুক্তরাজ্যকে এখনো সন্দেহজনক সম্পদ বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি প্রধান গন্তব্য হিসাবে দেখা হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নীতি পরিচালক ডানকান হেমস বলেছেন, ‘সরকারকে বিশ্বের চারপাশে মিত্রদের সাথে এবং বাংলাদেশে অংশীদারদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে। যেন অবৈধ অর্থ পাচারের বিষয়ে একটি নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থা চালু করা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের দাবি অনুযায়ী বিশ্বের দুর্নীতিবিরোধী রাজধানী হওয়ার পথে এই বিষয়টি তাদের জন্য একটি পরীক্ষা হতে পারে।’

দুর্নীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুশতাক খান মনে করেন, যুক্তরাজ্য সরকারকে কিছু সাহায্য বাজেট বাংলাদেশে তহবিল উদ্ধার করতে বিনিয়োগ করার কথা ভাবা উচিত।

তিনি বলেন, ‘পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধারের এই প্রচেষ্টাগুলো গণঅভ্যুত্থানের সময় যারা মারা গিয়েছিলেন তাদের সম্মানার্থে করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি বাংলাদেশে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা ছিল। আমরা নিহতদের হতাশ করতে পারি না।সূত্র : বা খ

আরও খবর

Sponsered content